কানের যত সমস্যা তত সমাধান!

 In Articles

কানে জমা ময়লা, সোজা বাংলায় যাকে বলে ‘খইল’। কানের এই খইল পরিষ্কার করার অভ্যাস আছে আপনার? তাহলে খবরটা আপনার জন্য সুখের নয়। কারণ, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, কানের খইল (ময়লা) পরিষ্কার না করে ‘পুষে’ রাখুন।

ভাবছেন, তাহলে তো ময়লা জমে কানের ক্ষতি হতে পারে! অথবা কান চুলকাবে, শিরশির করবে! এই ধারণা পুরোপুরি ভুল। ল্যাবএইড হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ সাবাহ উদ্দিন আহমেদ বললেন, কানের ময়লা সাধারণত কোনো ক্ষতি করে না। বরং এটি কানকে সুরক্ষিত রাখে। কানের ভেতরে পাইলোসেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড থেকে নির্গত সেরুমিনই হচ্ছে এই খইল বা ‘ময়লা’, যা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের আক্রমণ থেকে কানকে সুরক্ষিত রাখে।

কানের নালিতে সামনের দিকে থাকা এই পাইলোসেবাসিয়াস গ্ল্যান্ডের ক্ষরণের পাশাপাশি এর সঙ্গে বাইরের ধুলাময়লা মিশে যায়। এর ফলে কানে জমা হয় খইল। এটা আসলে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষারই অংশ। চলাফেরার সময়ে বাইরে থেকে কোনো ধরনের পোকামাকড় কানে ঢুকতে গেলেও এই খইল বাধার সৃষ্টি করে। সাধারণত কানে যখন খইল বেশি জমে যায়, তখন কান সেটা আপনা-আপনি বাইরের দিকে ঠেলে দেয়। কোনো কোনো সময় খইল বাইরে না-ও আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে তা বের করে আনা যায় বলে জানালেন সাবাহ উদ্দিন আহমেদ।

তবে অনেক সময় খইল বেশি শক্ত হয়ে যায়। তখন সহজেই কান থেকে বের হয় না। সে ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণে অলিভ অয়েল দিয়ে কটনবাটের মতো নরম কিছুর সাহায্যে আলতো করে বের করে নিতে পারেন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তবে হুটহাট করে কানের মধ্যে খোঁচানো একেবারেই ঠিক নয়। অনেকেই রাস্তার পাশে বসে দিব্যি কান পরিষ্কার করিয়ে নেন। এটা ভীষণ বিপজ্জনক! কান যদি পরিষ্কার করতেই হয়, নিজে করুন বা বাসার কারও সাহায্য নিন। তবে শেষ কথা একটাই—কান নিজেকে নিজেই পরিষ্কার রাখে। কানের ময়লার ক্ষেত্রে ওই গানটা খুব প্রযোজ্য, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও…।’[১]

কান চুলকাচ্ছে?
কানে কোনো কারণে অস্বস্তিকর অনুভূতি হলে অনেকেই কটন বাডের সাহায্যে কান পরিষ্কার করাটাকে তার যথার্থ সমাধান মনে করেন৷ কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা; বরং কটন বাড দিয়ে কান চুলকালে কানের সমস্যা হতে পারে৷
এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক-কান-গলা বিভাগের অধ্যাপক বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী৷ তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই কানের নিজস্ব কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে, যার মাধ্যমে কান পরিষ্কার হয়৷ তাই কোনো কারণে কানে কোনো সমস্যা হলেও কটন বাড দিয়ে কান পরিষ্কার করার কোনো প্রয়োজন নেই৷
কটন বাড ব্যবহারে কী সমস্যা হতে পারে?
১. যাঁরা কটন বাডের মাধ্যমে কান পরিষ্কার করে থাকেন, তাঁদের প্রাকৃতিকভাবে কান পরিষ্কার হওয়ার পদ্ধতিটি বাধাগ্রস্ত হয়৷
২. কয়েক দিন আগে খুলে রাখা প্যাকেট থেকে কটন বাড বের করে নিয়ে ব্যবহার করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ৷ আমাদের দেশে আর্দ্রতার প্রভাবে প্যাকেট খুলে রাখা কটন বাডে ছত্রাক জন্মায়, সেটি কানে ব্যবহার করলে কানে ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে৷
৩. কান পরিষ্কার করার সময় কোনো কারণে হঠাৎ চমকে উঠলে অসতর্কতাবশত কানে কটন বাডের আঘাত লাগতে পারে৷
৪. কটন বাড দিয়ে কান অহেতুক খোঁচাখুঁচির ফলে কানে আঘাত লাগতে পারে নিজের অজান্তেই, এমনকি ছিঁড়ে যেতে পারে কানের পর্দাও৷
৫. যদি কানের কোনো অসুখের কারণে কান চুলকায়, তাহলে কটন বাড ব্যবহারের কারণে অসুখের মাত্রা বেড়েও যেতে পারে৷

কখন কান পরিষ্কার করবেন?
শিশুদের ক্ষেত্রে ১৫ দিন বা এক মাস পর পর কানে জলপাই তেল দেওয়া যেতে পারে৷ তবে শিশুর কান পাকার সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে৷ বড়দের কানে ময়লা জমার তেমন কোনো কারণ নেই৷ তবে বারবার কানে বেশি বেশি ময়লা জমলে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন৷
জলপাই তেল ব্যবহারের নিয়ম
১. প্রতি কানে ৮-১০ ফোঁটা জলপাই তেল দিতে হবে৷
২. কানে তেল দেওয়ার পরে সেটি ফেরত আসার পর বাইরে থেকে তুলা দিয়ে মুছে দিতে হবে৷
৩. একই সঙ্গে দুই কানে জলপাই তেল দিলেও কোনো সমস্যা নেই৷ [২]

কানে পানি ঢুকলে কী করবেন?
সাঁতার কাঁটতে গেলে বা ঝরনার নিচে গোসলের সময় অনেক ক্ষেত্রে হঠাৎ কানে পানি ঢুকে যায়। তবে বেশি পরিমাণে পানি না ঢুকলে তেমন একটা সমস্যা হয় না। কানের ভেতরের ওয়াক্স অল্প পরিমাণ পানি শোষণ করে নেয়।

তবে কানে বেশি পরিমাণ পানি গেলে সমস্যা হতে পারে। আর কারো কানে যদি ছিদ্র থাকে বা আগে থেকে সংক্রমণ থাকে, তাদের ক্ষেত্রে কানে পানি গেলে সমস্যা হতে পারে। তাই কানে পানি ঢুকলে সাবধান। যাদের এ ধরনের সমস্যা আছে তাদের যাতে কানে পানি না ঢোকে সেই ব্যবস্থা আগে থেকে নিতে হবে।

যাদের মধ্যকর্ণে প্রদাহ সিএসওএম আছে তাদের সাঁতার কাটতে যতই ইচ্ছে করুক পানিতে নামা যাবে না। কারণ, কানে পানি ঢুকলে কিন্তু সংক্রমণ বাড়বে।

এমনকি গোসলের সময় দুই কানে তুলা গুজে দিন। যাঁরা নিয়মিত সাঁতার কাটেন বা সুইমিং পুলকে ভালোবাসেন তাঁরা গোসলের আগে কানে তুলা গুজে নিতে পারেন। নোংরা পুকুর বা সুইমিং পুলে সাঁতার কাটবেন না।

সাবান ও শ্যাম্পু কানের ছিদ্র থেকে দুরে রাখুন। কটন বার্ড দিয়ে অযথা কান খোচানোর অভ্যাস থাকলে সেটা দূর করুন। এতে কানের ময়লা বের করতে গিয়ে কানে সংক্রমণ হতে পারে। অনেক সময় কানের পর্দা ফুটোও হয়ে যেতে পারে।

আর কানের ময়লা বের করার দরকার হয় না। এটা এভাবেই তৈরি যে, আপনা আপনি ময়লা বের হয়ে আসে। যদি কানের ময়লা অনেক বেশি হয় যে কানের ছিদ্র পূর্ণ হয়ে যায়, শুনতে অসুবিধা হয়, তাহলে চিকিৎসকের সাহায্য নিন, তবুও কটনবাড ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন।

পানি কানের মধ্যে ঢুকতেই পারে। ভয় পাবেন না। আমরা ছোটবেলায় প্রকৃতিগতভাবে অনেক কিছুই শিখে থাকি। যেমনটা শিখি কানে পানি গেলে। কানে পানি ঢুকলে সাথে সাথে মুরব্বিরা কান কাত করে ঝাঁকাতে বলতেন। সেই সাথে দাঁতে দাঁতে কাটতে বলতেন। এটা কিন্তু বৈজ্ঞানিক। এটা করতে পারেন।

সাথে হাতের তালু দিয়ে কানের ছিদ্রপথে জোরে চাপ দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে হাত সরিয়ে নিন। এতে ভ্যাকুয়ামের মতো কাজ করে পানি বের হয়ে আসবে।

ভ্যালসালভা মেনুভার করতে পারেন। এর মানে হলো, প্রথমে নাক শক্ত করে চেপে ধরুন। এরপর মুখ শক্ত করে বন্ধ করুন। এখন আস্তে আস্তে নাক দিয়ে বাতাস ছাড়তে চেষ্টা করুন। নাক চেপে ধরেছেন তাই চাইলেও কিন্তু বাতাস বের হবে না। ফলে কানে চাপ পড়বে। এতে পানি বের হয়ে আসতে পারে।

এবার যে কানে পানি ঢুকেছে সে দিকে কাত হোন। তবে যাদের কানে সমস্যা আছে যেমন মধ্যকর্ণের ইনফেকশন, তাঁরা এমনটা করতে যাবেন না। আবার নাক দিয়ে খুব বেশি জোরে বাতাস ছাড়ার চেষ্টা করবেন না। এতে কিন্তু কানের পর্দায় সমস্যা হতে পারে।

ছোটবেলায় কানে পানি ঢুকলে আমরা সরিষার তেল কানের ভেতরে দিয়ে কিছুক্ষণ পর কান কাত করলে পানি আপনাআপনি বের হয়ে আসত। এটা করতে পারেন তবে সরিষার তেলের চেয়ে অলিভ অয়েল এ ক্ষেত্রে ভালো কাজ করবে। তিন/চার ফোঁটা অলিভ অয়েল কানে দিয়ে মিনিট দশেক রাখুন। এবার যে কানে পানি ঢুকেছে সে দিকে কাত হন। পানি বের হয়ে যাবে।

হেয়ার ড্রায়ার দিয়েও কাজ সারতে পারেন। যে কানে পানি ঢুকেছে সে কানে হেয়ার ড্রায়ারের বাতাস দিন। পানি থাকলে তা বাষ্প হয়ে বের হয়ে যাবে। তবে কানের খুব কাছ থেকে দেবেন না। বেশিক্ষণও দেবেন না।

গরম পানিতে তোয়ালে বা পাতলা কাপড় ভিজিয়ে নিয়ে কানে ধরুন। ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট পর্যন্ত ধরে রাখুন। চার/পাঁচবার এভাবে করুন। এরপর যে কানে পানে ঢুকেছে সেদিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ুন।

ভাপ ওঠা পানির ভাপ নাক দিয়ে টানতে থাকুন মিনিট দশেক ধরে। মাথা কাত করে রাখুন কিছুক্ষণ। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড তিন/চার ফোঁটা দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে কাত হয়ে শুয়ে পড়ুন।

এত কিছু করার পরও যদি পানি বের না হয় বা কান ভারী ভারী লাগে অথবা কানে শুনতে সমস্যা হয় তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যান। অবহেলা করবেন না। চিকিৎসক আপনার কান পরীক্ষা করে দেখবেন পানি আছে কি না। [৩]

Recent Posts

Leave a Comment

Contact Us

We're not around right now. But you can send us an email and we'll get back to you, asap.